,

নবীগঞ্জে সন্তানের নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে প্রবাসী মা’র কাছে টাকা দাবি

মতিউর রহমান মুন্না ॥ নবীগঞ্জে টাকার জন্য ৬ বছরের শিশু জিসান মিয়াকে নগ্ন করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে তারই আপন চাচা। নির্যাতন করে নির্যাতনের সেই ভিডিও ফুটেজটি শিশু জিসানের সৌদি প্রবাসী মায়ের নিকট অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ইমুতে পাঠিয়ে টাকা দাবি করা হয়েছে। নির্যাতনের এমন দৃশ্য সইতে না পেরে সৌদি আরব থেকে ছুটে এসেছেন মা সুমনা বেগম। এ ঘটনার খবর পেয়ে গতকাল বুধবার ভোরে নবীগঞ্জ থানার ওসি মোঃ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ শিশুর চাচা স্বপন মিয়াকে গ্রেফতার করেছে। নির্যাতনের শিকার শিশুর মা সুমনা বেগম বাদী হয়ে নবীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। স্থানীয়রা জানান, নবীগঞ্জ পৌর এলাকার চরগাঁও গ্রামের সুফি মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় হবিগঞ্জ সদরের উমেদনগর এলাকার সুমনা বেগমের। বিয়ের পর তাদের সংসারে জন্ম নেয় এক ছেলে ও এক মেয়ে। এর কিছু দিন পরই সুফি মিয়া মারা যান। তার মৃত্যুর পর সন্তানদের কথা চিন্তা করে জীবিকার তাগিদে সুমনা গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সেখানে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারেননি তিনি। টাকার জন্য তার একমাত্র সন্তানকে নির্যাতন করতে থাকে দেবর স্বপন মিয়া। আর সেই নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে তার কাছে পাঠানো হয়। তা দেখে হতভাগা মা সন্তানকে নির্যাতনকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে ধাপে-ধাপে স্বপনের কাছে টাকা পাঠান তিনি। সেই টাকা উত্তোলন করে স্বপন। বিষয়টি এলাকাবাসীর নজরে এলে স্থানীয় মুরব্বিদের সহযোগিতায় শিশু জিসান ও তার বোনকে মামার মাধ্যমে নানাবাড়ি পাঠানো হয়। এদিকে এ ঘটনার খবর পেয়ে গতকাল বুধবার ভোরে নবীগঞ্জ থানার ওসি মোঃ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে ও ওসি (তদন্ত) উত্তম কুমার দাশ, সেকেন্ড অফিসার এসআই শামসুল ইসলামসহ একদল পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অবশেষে বানিয়াচং উপজেলার খাগাউরা গ্রাম থেকে নির্যাতনকারী স্বপন মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। সরেজমিনে চরগাঁও গ্রামে শিশুর স্বজনরা জানান, বাবা হারা ছোট্ট দুই শিশুকে দাদা-দাদি আর চাচার কাছে রেখে জীবিকার তাগিদে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব গিয়েছিলেন সুমনা বেগম। আর যাওয়ার আগে সন্তানদের দেখাশোনার জন্য তাদের চাচাকে কিছু টাকাও দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সৌদি আরব যাওয়ার দুই মাস যেতে না যেতেই তার সন্তানদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। টাকা দেয়ার জন্য ৬ বছর বয়সী আপন ভাতিজাকে নগ্ন করে নির্যাতন করে সেই ভিডিও তার মায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন চাচা স্বপন। জিসানের মা সুমনা বেগম প্রতিবেদককে জানান, ‘কয়েক বছর আগে আমার স্বামী মারা গেলেও আমি শ্বশুর বাড়িতেই থাকতাম। সুমাইয়া (৮) নামে আমার একটি মেয়ে রয়েছে। গত দুই মাস আগে আমি শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরব যাই। সৌদি আরব যাওয়ার আগে আমি আমার দুই শিশু সন্তানকে দেবর ও শ্বশুড়-শাশুড়ির কাছে রেখে যাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে গিয়ে ছিলেন। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই তার কাছে দেবর স্বপন আরও টাকা দাবি করে। এরপর জিসানকে অমানুষিক নির্যাতন করে তা ভিডিও করে সৌদি আরবে তার কাছে পাঠায় স্বপন। পরে এই ভিডিও দেখে তিনি গত শুক্রবার দেশে ফিরে আসেন।’ সুমনা বেগম আরো জানান, বর্তমানে তিনি তার দুই সন্তানকে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে তার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবে যাওয়ার আগে দেবর স্বপনকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি রিক্সা কিনে দেন এবং নগদ ২০ হাজার টাকা দিয়ে যান যাতে তার সন্তানদের দেবর দেখে রাখে। বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য স্বপনকে একটি স্মার্টফোনও দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই মাস পার না হতেই তার ছেলেকে মারধর করে সেই মোবাইল দিয়েই ভিডিও করে তার কাছে পাঠায়। ভিডিও দেখে তিনি সৌদি আরবে তার মালিকের কাছে কান্নাকাটি করলে চলতি মাসের বেতনসহ ওই মালিক তাকে দ্রুত দেশে পাঠান।’ নির্যাতনের ভিডিও ক্লিপটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একটি ঘরের মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে গায়ে কোনো কাপড় ছাড়া ৬ বছরের শিশু জিসান। তার দিকে তেড়ে গিয়ে বাজে ভাষায় গালাগালি করতে করতে লাথি মারছেন অভিযুক্ত চাচা স্বপন। এতে আরও দেখা যায়, চড়-থাপ্পড় এবং লাথি-ঘুষি মারার পরে স্বপন শিশুটির গোপনাঙ্গ ধরেও টান দিচ্ছেন। এরপর ওই শিশুটির দুই পা ধরে তাকে উল্টো দিকে ঝুলিয়ে আছাড় মারার ভয় দেখাচ্ছিলেন। তখন শিশু জিসান বার বার ‘ও মা’, ‘ও মা’ বলে চিৎকার করছিল। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি জানান হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যাহ। তিনি জানান, নবীগঞ্জ পৌর এলাকার চরগাঁওয়ের সুফি মিয়ার সঙ্গে সুমনা বেগমের বিয়ে হয়। সুফির মৃত্যুর পর ছোট দুটি শিশুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সৌদি আররে পাড়ি জমান সুমনা। প্রবাসে যাওয়ার আগে তার দুই শিশুকে দেবর স্বপন মিয়ার কাছে রেখে যান। কিন্তু সৌদি আরবে শান্তিতে থাকতে পারেননি তিনি। টাকার জন্য শিশুদের নির্যাতন করতে থাকেন স্বপন। হতভাগা মা সন্তানকে নির্যাতন থেকে বাঁচাতে ধাপে-ধাপে স্বপনের কাছে টাকাও পাঠান। কিন্তু তার নির্যাতন থেমে থাকেনি। সম্প্রতি শিশু জিসানকে নগ্ন করে নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে টাকা চেয়ে সুমনার কাছে পাঠানো হয়। এই দৃশ্য সইতে না পেরে ২ নভেম্বর দেশে ছুটে আসেন মা সুমনা। গত মঙ্গলবার নির্যাতনের ঘটনাটি সামাাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হলে এলাকায় আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার রাতে সুমনা আক্তার বাদী হয়ে নবীগঞ্জ থানায় স্বপনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি আরো জানান, পুরো ঘটনাটি এখনো তদন্তাধীন রয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে আরো কারো স¤পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া সুমনাকে বউ হিসেবে দাবি করছে স্বপন। কিন্তু স্বপনের সঙ্গে বিয়ের কথা অস্বীকার করছেন সুমনা। তদন্ত শেষ হলে এ ঘটনার আরও বিস্তারিত জানা যাবে। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত এসপি শৈলেন চাকমা, এএসপি এসএম রাজু আহমেদ ও নবীগঞ্জ থানার ওসি মোঃ আজিজুর রহমানসহ পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।


     এই বিভাগের আরো খবর